সমাজ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, দয়াদাক্ষিণ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা মনে রেখেও রবীন্দ্রনাথ বলেছিঠেন, ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি ভঙ্গভাষা’। তিনিই বিদ্যাসাগরকে ‘বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ বলে অভিহিত করে বাংলা গধ্যে তাঁর দানের বিস্তার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। মূল হিন্দি অবলম্বনে বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) লিখে বাংলাসাহিত্যে বিদ্যভসাগরের যাত্রা শুরু। এরপর তাঁর অনুবাদমূলক সাহিত্যকর্ম শকুন্তলা (১৮৫৪)-কালিদাসের 'অভিজ্ঞানশকুন্তল' নাটক এর অবলম্বন। তবে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত নাটককে বাংলায় আখ্যানের রূপ দিয়েছেন- মূলে সাতটি অঙ্ক অনুবাদে সাতটি পরিচ্ছেদের রূপ নিয়েছে। মূলে যা ক্রিয়ামূলক, অনুবাদে তা বিবৃতিমূলক, সংলাপ উভয়ই আছে। তবে তার চেয়েও বড়ো পরিবর্তন করেছেন রুচি ও বাস্তবতার বিবেচনায়।
কালিদাসের কালে রাজসভায় যে-আদিরসের জোগান সংগত এমনকী আবশ্যিক মনে হতো, উনিশ শতকের পাঠকসাধারণের জন্যে বিদ্যাসাগর তা রুচিকর বিবেচনা করেন নি। ফলে, মূলে যা প্রকট, তা কখনো আভাসে প্রকাশিত, কখনো বর্জিত। এইজন্যে সমালোচকেরা বলেন, কালিদাসের দুষ্মন্ত যেখানে কামুক, বিদ্যাসাগরের দুষ্মন্ত সেখানে প্রেমিক।
সংসারানভিজ্ঞা শকুন্তলার ব্রীড়াবনত ভাবটাও বাংলায় চমৎকার ফুঠে উঠেছে। কালিদাসের নাটকে বেশ কিছু অতিপ্রাকৃত উপাদান আছে। কাহিনির জন্যে যেটুকু অপরিহার্য-দুর্বাসার অভিশাপবৃত্তান্ত কিংবা দুষ্মন্ত কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা শকুন্তলাকে এক জ্যোতির্ময়ী পদার্থের আকাশপথে নিয়ে যাওয়া- সেটুকু ছাড়া আর সব অলৌকিকতাই বিদ্যাসাগর বর্জন করেছেন। পতিগৃহে যাত্রার সময়ে শকুন্তলা দেবদত্ত অলংকার লাভ করেছিলেন, সে-অংশটি বাদ দেওয়ায় সমকালীন সমালোচকেরা বিদ্যাসাগরের দোষ ধরেছিলেন। বিদ্যাসাগরের বাস্তবনিষ্ঠতার মর্ম তাঁরা বোঝেন নি।