
শকুন্তলা
শকুন্তলার অবলম্বিত রস যেমন মধুর, তেমনি এর ভাষা মাধুর্য ও প্রসাদগুণ-ম-িত। সংস্কৃত নাটকের ঐতিহ্য অনুসরণ করে কালিদাস যেখানে নারীচরিত্রের ও নিম্নশ্রেণির চরিত্রের মুখে প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন, বিদ্যাসাগর সেখানে একান্তই মৌখিক ভাষা প্রয়োগ করেছেন। গৌতমী ও শকুন্তলার এবং ধীবর ও নগররক্ষীর কথোপকনে তার পরিচয় আছে। এমনকী, দুষ্মন্ত ও মাধব্যের কথোপকথনে তৎসম শব্দ ব্যবহার করেও ভাষার একটা হালকা চাল বজায় রেখেছেন। ভাষার এই বৈচিত্র্য পাঠকের পক্ষে বিশেষ উপভোগ্য হয়েছে।
মূল নাটকের মতো বিদ্যাসাগরের শকুন্তলাও মিলনান্ত। কিন্তু বিদ্যাসাগরের রূপান্তর পড়ে পাঠকের ধারণা হয় যে, নারীদুঃখকাতর যে-বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলেনর জন্যে এবং বহুবিবাহ রহিত করার জন্যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আন্দোলন করেছিলেন, সেই বিদ্যাসাগরই আরো ভাগ্যহতা নারীর আলেখ্যরচনায় এখানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যে-নারী জন্মসময়ে জননী কর্তৃক পরিত্যক্তা এবং গর্ভবতী অবস্থায় স্বামী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাতা, নিজের অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাউকে যে নিজের মন্দভাগ্যের জন্যে দায়ী করতে পারে না, শকুন্তলা তেমন নারীর বৃত্তান্ত। বিদ্যাসাগর-রচিত এর পরবর্তী আখ্যান সীতার বনবাস (১৮৬০) পাঠ করলে এই ধারণা দৃঢ় হয়।
অনুবাদকর্মের মধ্যেও মৌলিক ¯্রষ্টা কেমনভাবে আত্মপ্রকাশ করেন, শকুন্তলা তার এক অসামান্য নিদর্শন।
বর্তমান মুদ্রণে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস-সম্পাদিত বিদ্যাসাগর-স্মৃতি-সংরক্ষণ-সমিতির পক্ষে রঞ্জন পাব্লিশিং হাউস-প্রকাশিত বিদ্যাসাগর-গ্রন্থাবলীর (১৩৪৪) পাঠ অনুসৃত হয়েছে।
আনিসুজ্জামান
জানুয়ারি ২০০৯
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলোকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।