হতাশ জীবন [সংগ্রহ ভূমিকা ও সম্পাদনা : অভীক ওসমান]
উপমহাদেশের ইতিহাসে বেশ কয়েকজন মৌলানা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। কয়েকজনের নাম উপমহাদেশের প্রান্ত ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। মৌলানা মনিরুজ্জামান এঁদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নন। কিন্তু তাঁর কীর্তির (রাজনীতিতে, সামাজিক অর্থনীতিতে, শিক্ষা প্রসারে এবং বঞ্চিতজনের বঞ্চনা মোচনে) সামগ্রিকতা বিচার করলে তিনিই সর্বাগ্রগণ্য। অভীক ওসমান মাওলানা এছলামাবাদীর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশাল কোন গবেষণা কর্ম করেননি; তিনি মৌলানার বহুধাবিস্তৃত কর্মযজ্ঞের কয়েকটি অজানা দিকের সন্ধান মাত্র দিয়েছেন পাঠককে। অভীক ওসমানের এই কাজের অনন্য দিকটি হলো তিনি মৌলানা সাহেবের জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে লেখা অপ্রকাশিত রচনা ‘হতাশ জীবন’কে পাঠকের গোচরীভূত করেছেন। এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি মৌলানার প্রেক্ষাপট, বিশেষভাবে তাঁর জন্মভূমিÑশঙ্খের কূলের অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্য, আরবী ও ইসলামী শাস্ত্রে তাঁর দক্ষতা অর্জন, বিশেষভাবে তিনি যে বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন, তা পাঠকের, বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। অভীক ওসমান লিখেছেন, আড়ালিয়ার চরের মিশনারী মাওলানার উপর একটি গতানুগতিক গ্রন্থ সম্পাদনার উদ্দেশ্য আমার বা প্রকাশক মহোদয়ের নয়। আমরা মাওলনার আত্মজীবনীর অপ্রকাশিত ‘হতাশ জীবন’ অংশটি সুধী পাঠকমহলে পেশ করলাম। এখানে মাওলানার নিখিল জীবনের নিরন্তর সংগ্রামের একটি অংশ পাওয়া যাবে। মাওলানার জন্মস্থান আড়ালিয়ার চর। ভাসানের চরের মাওলানাÑমওলানা ভাসানী। ভাসানী হুজুর মাওলানার ভাবশিষ্য ছিলেন। শঙ্খ উপকূলবর্তী সেনের চরে জন্মগ্রহণ করেছেন যাত্রামোহন সেন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন গুপ্ত, চরশেবনদীতে জন্মগ্রহণ করেছেন পূর্ববঙ্গের বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠাতা, বাংলার বিজ্ঞান বইয়ের প্রচলনকারী ভাষাসৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। মাওলানার জন্মের আঁতুড়ঘরের সাথে কেশুয়া গ্রামবাসী মৎ আঁতুড়ঘর একই সুতোয় বাঁধা বলে মাওলানার উপর লেখালেখির ব্যাপারে আমার এই আবেগ। বিরাট এক মনীষীর সঙ্গে একই গ্রামে জাত-হওয়ায় অভীক ওসমান আবেগাপ্লুত! তার আবেগের ভিত্তি নেই? কেউ যদি জগদীশচন্দ্র বসু বা মাইকেল মধুসূদনের গ্রামে জন্মান, তাহলে তাঁর এই শেকড় বা শেকড়ের মাটি নিয়ে উদ্ভাসিত হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? অভীক ওসমান কবি, তাই তার কল্পনার চোখে বার বার এই বিরাট মানুষটির ছবি অসমান্য আলোকে ফুটে উঠেছে। যেখানে তার মা’র নানা ছিলেন এই অনন্যসাধারণ মানুষটির সহকর্মী। কবিজনোচিত অনুভূতি দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন মনিরুজ্জামান এছলামাবাদীর সব কাজকে, সব কীর্তিকে। তখনকার মুসলিম সমাজের সবক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মৌলানার হৃদয়কে কিভাবে আলোচিত করেছিল এবং এই সমাজকে মুক্তি দেয়ার জন্য তিনি যে কি-ব্যাকুল হয়েছিলেন তা ‘হতাশ জীবন’-এর ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট। হাবিবুল্লাহ বাহার লিখেছেন, পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজের কথা ভেবে মৌলানা সারাজীবন কেঁদেছেন পাগলের মতোÑমুসলমান লেখাপড়া শিখছে না, শিল্প-বাণিজ্যে আসছে না, খবরের কাগজ পড়ছে না, যথাযথভাবে রাজনীতির চর্চা করছে না। এসবই এছলামাবাদীকে বেদনায় উদ্বেল করেছিল। বেদনার্ত হয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, মুষড়ে পড়েননি। এই নিদারুণ অবস্থা থেকে মুসলমান সমাজকে অন্তত এর একটা অংশকে মুক্ত করার জন্য তিনি কত না কর্মের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কিছুই ছিলো না, কিন্তু তা তাঁকে কর্ম থেকে, পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নেয়ার বিভিন্ন প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে রাখতে পারেনি; তিনি হতোদ্যম হননি। সংবাদপত্র প্রকাশনা থেকে আরম্ভ করে কৃষি সংস্কার, মাদ্রাসা-শিক্ষা সংস্কার, ইসলামী মিশন প্রতিষ্ঠা, এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণÑসমাজ আর দেশের জন্য আর কি করতে বাকী রেখেছিলেন তিনি? শতমুখী এই কর্মযজ্ঞই কেড়ে নিয়েছিল মাওলানা এছলামাবাদীর জীবনের সিংহভাগ সময়। স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের জন্য প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। আবু হেনা মোস্তফা কামাল যথার্থভাবেই বলেছেন, তিনি ছিলেন কালাপাহাড়ী ব্যক্তিত্ব। আরবী ফার্সী ও উর্দু ভাষায় ছিল তাঁর ঈর্ষণীয় পাণ্ডিত্য। তিনি মুসলিম ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলোর দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বারবার; লিখেছেন বহু বই, প্রায় সবই উৎকৃষ্ট বাংলা গদ্যে। ইসলাম ধর্মের চর্চা ছিলো তাঁর আজীবন সাধনা। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ধর্মান্ধতার ঘোর বিরোধী। মুক্তির মহৎ সাধক। তাঁর ইন্তেকালের বেশ কিছু দিন পরে তাঁরই সহকর্মী হাকিম আলতাফুর রহমান মৌলানার রচিত ৯৪টি গ্রন্থ বাংলা একাডেমীকে দিয়েছিলেন প্রকাশের জন্য। এই গ্রন্থগুলো প্রকাশের ব্যাপারে বাংলা একাডেমী সিদ্ধান্ত নিলেও আজও পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়নি। অভীক ওসমানের গ্রন্থের বৈশিষ্ট হলো এই, উপমহাদেশের এক বিশেষ কালপর্বে এছলামাবাদী যে কি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং তার অনন্যতা কোথায় ছিল তা পাঠকের কাছে উদঘাটিত করেছেন তিনি। আজীবন ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এছলামাবাদী। দ্বিজাতিতত্ত্বকে কখনো স্বীকার করে নেননি। পিছিয়ে পড়া মুসলমানের মুক্তি তাঁর আরাধ্য ছিল কিন্তু তার জন্য অন্য মানুষের অধিকার খর্বে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীনতা সব মানুষের জন্মগত অধিকার। কারণ একজন মানুষ যতক্ষণ না স্বাধীন হচ্ছে, ততক্ষণ সে তার মনুষ্যত্বকে পূর্ণতা দিতে পারে না। ১৯৭১ সালে যে-স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, এছলামাবাদীর জীবনব্যাপী চিন্তাধারা ও কাজের মধ্যে তারই যেন এক প্রাক-প্রস্তুতি দেখা যায়। অভীক ওসমানের গ্রন্থের সার্থকতা এই সত্য উদঘাটনেই এই দিকনির্দেশনাতেই নিহিত রয়েছে বলে আমার মনে হয়। - ড. অনুপম সেন, উপাচার্যের কার্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।