আমাদের দাদা সাদেক খান
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের শিক্ষিত তরুণ অংশকে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত করে আধুনিক ও অগ্রসরমান চিন্তা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত করার কাজে তার অবদানের কথা তেমন জানেন না। শুধু রাজনৈতিক নয়, তার সাংস্কৃতিক চিন্তাধারাও ছিল প্রথাবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল। তার এই ভূমিকা একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মধ্যবিত্ত বাঙালির তরুণ প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িকতার মোহমুক্ত হওয়ার কাজে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, অমর একুশের গানের রচয়িতা সাদেক মূলত অসম্ভব অস্থির চিত্তের মানুষ ছিল। তার মাথার ভেতরে একসাথে অনেক কিছু কাজ করত। যখন যেটা করত পাগলের মতো করত এবং সেখানে তার আধুনিক মননশীলতা ছাপ রেখে যেত। ব্যক্তিগত জীবনযাপনেও সাদেক খুবই আধুনিক মনের মানুষ ছিল এবং জীবনকে উপভোগ করত। মুর্তজা বশীর। কবি, কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, মুদ্রাবিদ। সাদেক ভাই বিতর্ক ভালোবাসতেন, কখনো ধৈর্য হারাতেন না, প্রকাশে উষ্মা প্রকাশ ছিল তাঁর অজানা। বিতর্কে এই জ্ঞানী মানুষটিকে পরাজিত করা সহজ ছিল না। ফারুক চৌধুরী। কুটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব During the Liberation War, Sadeq Khan worked with the government in exile and was informally assigned for logistic support and external publicity, keeping connection with the Sector Commanders and cultural activists. He also worked for mobilising global support in favour of the war of independence Sayed Kamaluddin. Editor, Weekly Holiday জেল থেকে বেরুনোর পরপরই কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সাদেক খান আত্মগোপনে চলে যান। কঠিন জীবনযাত্রা, পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে সাদেক খান যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। দীর্ঘ চিকিৎসা নিয়ে তিনি পরবর্তীতে যক্ষ্মা থেকে সুস্থ হলেন বটে, তবে তার শিক্ষাজীবনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক ও ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আমাদের জন্য দুঃখের বিষয় এই যে আমরা একজন প্রতিভাবান পদার্থবিদ অথবা গণিত শাস্ত্রবিদের কাছ থেকে বঞ্চিত হলাম। কারণ তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর চালিয়ে যেতে পারলেন না। রাজনীতির কারণে তাঁকে যেতে হয়েছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে। ক্লাসরুমে বসার চেয়ে মানবমুক্তির সংগ্রামকে অধিকতর প্রয়োজনীয় বলে বেছে নিয়েছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো। রাজনীতিক, লেখক, সাবেক ছাত্রনেতা বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার কূটচাল আর স্থানীয় সমাজপতিদের ছলে-বলে বিক্ষত-বিভাজিত বঙ্গভূমির আর্তচিৎকারে প্রকৃতই যে চৈতন্যোদয় হয়েছিল সে কালের শিরোনাম বায়ান্ন। যেন শতবছর ধরে খুঁজে চলা স্বাধীনতার কক্ষপথ খুঁজে পায়- বাংলাদেশ। মুখে মায়ের ভাষা আর বুকে অমিত তেজ নিয়ে বাংলার অসংখ্য সন্তান মাতৃভূমির দীর্ঘযুগের অপমান আর পরাধীনতার অবসান চায়। এই আকাক্সক্ষায় আমাদের যে অগ্রজরা মেধা আর সাহসে, শ্রমে আর সৃষ্টিশীলতায় সময়ের অনুপ্রেরণা হয়েছেন, অন্যদেরকে আকৃষ্ট করেছেন, তাদের একজন সাদেক খান। বর্তমান বাংলাদেশের যা-কিছু কাঠামো ততটুকুর চূড়ান্ত ভিত্তি নির্মিত হয়েছে ৫০’র দশকে। বিদ্রোহের সুর, অন্নের যোগান, বেসাতির কায়দা, শিল্পের ছোঁয়া বা জ্ঞানের সংশ্লেষণ, জাতিরাষ্ট্রের জন্ম-বিকাশের পথে বিশাল কর্মযজ্ঞের ঐ দূরন্ত সময়ে এক দ- বসে ছিলেন না সাদেক খান। আন্দোলনের সংগঠক, শিল্পের কারিগর, উদ্যোক্তা বা বিদ্বান-এই সকল উপাধি তার গায়ে যুতসই-এমন কথা তার নিন্দুকেরাও তাই স্বীকার করেন দ্বিধাহীন চিত্তে। যৌবনের সেই উন্মাদনা সাদেক খানকে পরবর্তী জীবনে ভাসিয়েছে অলক্ষ্যের লক্ষ্যে। বিপুলা জীবনের নানা রং যখন তিনি গায়ে মাখিয়েছেন তখন আমরা বিস্মিত হয়েছি, বিস্মৃত হয়েছি। যদিও তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। যৌবনেই তিনি জীবন বৈচিত্র্যের রস আস্বাদন করেছিলেন। পরিবারের প্রাসাদ ছেড়ে রেল লাইনের দু’ধারে ঘুমিয়েছেন সমান পৃথিবীর আশায়। নতুনের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। শৃঙ্খলায় পরাধীন ভাবতেন নিজেকে। জীবনকে ‘পারফরমিং আর্ট’ হিসেবে গ্রহণ করে যাপন করতে চেয়েছিলেন। চিত্রনির্মাতা, অভিনেতা, পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিল্প সমালোচক, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজগবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী বা নির্মোহ সাধারণ মানুষ ইত্যাদি চরিত্রসমূহ তিনি উপস্থাপন করেছেন অনায়াস পারঙ্গমতায়। জগতটাকে বুঝতে চেয়েছিলেন যুক্তি দিয়ে, জীবন যাপন করেছেন খেয়ালে। তবে মানুষ আর প্রকৃতির প্রতি নির্মোহ এক প্রেমের আলোতে তার যুক্তি ও খেয়ালের সংঘর্ষ হয়নি কখনো। যুক্তির দায়িত্বে সাদেক খান পরিবারের “বড় দাদা”। আবার মনের খেয়ালে দূরে এক নির্জন জীবন শিল্পী। রাজনীতি সচেতন সমাজ সংলগ্ন এই মানুষটির মত-পথের বিভিন্নতায় অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, বাম থেকে ডানের দোদুল্যতার কারণে তাকে দূরে ঠেলে দেয়া যেতে পারে। তবে জীবনের প্রতি আমুদে স্বভাব, বিনয়-বিদ্যার সহজ প্রকাশ আর সৃজনশীল মনন বৈশিষ্ট্য সাদেক খানকে উদ্ভাসিত করেছে অন্য আলোয়। এ সংকলনে নানা মাত্রার লেখা ও ছবির মাধ্যমে সাদেক খানের যে প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে বিশেষভাবে তাঁর অসমাপ্ত আত্মস্মৃতি, তাঁর পরিবারের নানা বয়সের পরিজনদের লেখা, তাঁর প্রিয় বন্ধুদের লেখা, আর তাঁর চিন্তা বিকাশের অসংখ্য লেখা থেকে নিজস্বতার কিছু চুম্বক লেখা। আমরা এই সংকলনে গ্রন্থিত করেছি। আশা করি সকল শ্রেণির পাঠক তা থেকে একটা নিজস্ব ধারণা ও মতামত গড়ে তুলতে পারবেন এই সংকলনে।