
স্বর্ণলতা
ভ্রাতৃবধূদের দ্বন্দ্বকলহে একান্নবর্তী পরিবারে কেমন করে ভাঙন ধরে, স্বর্ণলতা তারই কাহিনি। জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ প্রমদার কুটিলতা ও নীচতার বিপরীতপক্ষে এতে কনিষ্ঠ ভ্রাতৃজায়া সরলার সারল্য ওসহনশীলতা স্থাপিত হয়েছে। পরিণামে ঘটেছে পুণ্যের জয় ও পাপের পরাজয়। একদিকে করুণরসের জোগান, অন্যদিকে নীতিকথার সন্নিবেশ পাঠকের মনকে বিশেষ করে আকৃষ্ট করেছিল। স্বর্ণলতার চরিত্রগুলি একরৈখিক : শঠ ও ক্রূর, সৎ ও সরল, মূর্খ ও ভাঁড়, সদানন্দ এবং নিস্পৃহÑএমনি সব চরিত্রের সমাবেশ এতে ঘটেছে। তবে চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্ব সবসময়ে পরিস্ফুট হয়নি, বিশেষত যার নামে উপন্যাসের নামকরণ, সেই স্বর্ণলতা অনেক পরিমাণে অস্ফুট। ঔপন্যাসিকের অসাধারণ চরিত্রসৃষ্টিক্ষমতার পরিচয় বহন করে নীলকমল ও গধাধরচন্দ্র-শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা-‘ঊৎকেন্দ্রিকতার পাজী ও নিরীহ এই দুই প্রকার শ্রেণীর নিদর্শন’। নীলকমল সম্পর্কে সুকুমার সেনের মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য: মূল আখ্যানবস্তুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ না থাকিলেও স্বর্ণলতার ভূমিকাগুলির মধ্যে নীলকমলই উজ্জ্বলতম। গল্পের মধ্যে নীলকমলের আবির্ভাব যেমন আকস্মিক তিরোভাব তেমনিই বেদনাদায়ক।... নীলকমলকে দিয়া কিছু হাস্যকৌতুকের সৃষ্টি করা বোধ হয় লেখকের আসল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু চরিত্রটির মধ্যে যে অসামান্যতা ও বাস্তবতা আছে তাহাই ইহাকে সকরুণ সমবেদনায় ও সর্বকালীন মানবত্বে ম-িত করিয়া বাঙ্গালা সাহিত্যে অমর করিয়াছে।
নীলকমলের সূত্রে পথিকজীবনের যে-আলেখ্য তারকনাথ রচনা করেছেন, তার অভিনবত্ব অবশ্যস্বীকার্য। গদাধরচন্দ্রের প্রতি পাঠকের সহানুভূতির কোনো কারণ থাকে না, যদিও তার ত-বর্গের বদলে ট-বর্গের উচ্চারণ যথেষ্ট হাস্যরসের অবতারণা করে। কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে স্ত্রীলোকের সজ্জায় সজ্জিত গদাধর যখন ঘরের দিকে আশ্রয় নিতে গিয়ে ‘ঐ তরলে ডিডি’ বলে চিৎকার করে ওঠে, তখন তার জন্যে খানিকটা মায়া হয়।
একথা ঠিক যে, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষমতা তারকনাথের ছিল না। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র তাই সাধারণ। অন্যদিকে তাঁর উপন্যাসটিতে দৈবের একটা ভূমিকা আছে। বাস্তবধর্মী উপন্যাসে দৈবের মুহুর্মুহু হস্তক্ষেপ প্রত্যাশিত নয়। সমালোচকদের কেউ কেউ স্বর্ণলতার বাস্তবচিত্রকে শিল্পকর্মহীন আলোকচিত্র বলে অভিহিত করেছেন। এ হয়তো বইটি সম্পর্কে সমকালীন উচ্ছ্বাসের পত্রিক্রিয়া। এ-কথা অস্বীকার করা যায় না যে, বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্স ও তাঁর অনুসারীদের রচনা যখন আমাদেরকে উচ্চ ভাবকল্পনাময় ক্ষেত্রে ক্রমাগত আকর্ষণ করছিল, তখন সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে বস্তুনিষ্ঠ চিত্রাঙ্কন করে তারকনাথ বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। এ-বিষয়ে তাঁর সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যাবে। স্বর্ণলতার দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদে।
স্বর্ণলতার চরিত্রগুলি যেমন সাধারণ, এর ভাষা ও তেমনি সরল ও প্রাঞ্জল-উচ্চাঙ্গের কাব্যকলার পরিচয় তাতে নেই, বস্তুত সে-ভাষায় প্রসাধনকলার চিহ্নও একেবারে নেই। তবে এই ভাষায় অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গল্প করা চলেÑতারকনাথ তাই করেছেন।
প্রথম উপন্যাসের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তারকনাথ আরো কয়েকটি গল্প-উপন্যাস রচনা করেছিলেন, তবে তার কোনোটিই সার্থক হয়নি। কিন্তু প্রথম উপন্যাস তাঁকে যে সিদ্ধি দিয়েছিল, তাতেই বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থায়ী আসন রচিত হয়ে গেছে।
-আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।