সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।
Romesh Chunder Dutt / রমেশচন্দ্র দত্ত
রমেশচন্দ্র দত্ত ১৮ (১৮৪৮-১৯০৯) কলকাতার রামবাগানের বিখ্যাত দত্ত পরিবারের সন্তান। ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার জন্যে এই পরিবার সুপরিচিত ছিল। তাঁর পিতৃব্যদের মধ্যে কৈলাসচন্দ্র দত্ত হিন্দু পাইওনিয়ার পত্রিকার সম্পাদকরূপে, গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ইংরেজি কবিতরা রচনা করে এবং শশীচন্দ্র দত্ত ইংরেজি কথাসাহিত্যচর্চা করে যশস্বী হয়েছিলেন। রমেশচন্দ্রের ভ্রাতা যোগেশচন্দ্র ও কবিতা লিখতেন ইংরেজিতে। গোবিন্দচন্দ্র খ্রিষ্ঠধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর কন্যা তরু দত্ত ও অরু দত্ত ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় লিখে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
রমেশচন্দ্র ১৮৬৪ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এফ এ পাশ করে তিনি বি এ ক্লাসে ভর্তি হন, কিন্তু অধ্যয়ন অসমাপ্ত রেখেই ১৮৬৮ সালে বিলেত রওনা হন। তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন সামান্য জ্যেষ্ঠ সুরেবন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সহপাঠী বিহারীলাল গুপ্ত। ১৮৭১ সালে তাঁরা তিনজনই আই সি এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রমেশচন্দ্র ব্যারিস্টারি পরীক্ষায়ও কৃতকার্য হন। ১৮৭১ সালেই দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি বঙ্গদেশের নানা স্থানে কাজ করেন এবং উড়িষ্যায় কমিশনার ও করদমহলের সুপারিন্টেন্ডেন্টরূপে অবসর নেন ১৮৯৬ সালে। পরে তিনি বরোদা রাজ্যে সচিব ও দেওয়ানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। সরকার তাঁকে সি আই ই উপাধি প্রদান করেন এবং বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য মনোনীত করেন। পরে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং এর সভাপাতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও সভাপতি ছিলেন। ১৯০৯ সালে তিনি বরোদায় মৃত্যুবরণ করেন।
রমেশচন্দ্র ইংরেজি প্রচুর লেখেন। তার মধ্যে ArCy Dae ছদ্মনামে রচিত The literature of Bengal (১৮৭৭) এবং দু খ- The Economic History of India (১৯০২-০৪) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঋগে¦দ-সংহিতা (১৮৮৫) তাঁর বিশেষ কীর্তি। বমিঙ্কমচন্দ্রের পরামর্শে তিনি বাংলা সাহিত্যচর্চায় প্রবৃত্ত হন। বঙ্গবিজেতা (১৮৭৪), মাধবীকঙ্কণ (১৮৭৭), মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত (১৮৭৮) ও রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা (১৮৭৯)-ইতিহাসমূলক এই চারটি উপন্যাস মুঘল-শাসনে এক শ বছরের পটভূমিতে রচিত বলে তা একত্রে শতবর্ষ (১৮৯৭) রূপে প্রকাশিত হয়। সংসার (১৮৮৬) ও সমাজ (১৮৯৪) তাঁর সামাাজিক উপন্যাস। সংসারে বিধবাবিবাহের প্রতি লেখকের সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।
রমেশচন্দ্র সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় অধ্যয়ন করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য থেকেই তিনি সাহিত্য রচনায় প্রেরণালাভ করেন। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসরচনার মূলে ছিল স্টটের প্রভাব। রমেশচন্দ্র ইতিহাসের সত্যকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছিলেন, তুলনায় ঔপন্যাসিকের কল্পনাকে অপেক্ষাকৃত সংযত রেখেছিলেন। এ-কথা তাঁর প্রথম উপন্যাসদুটি সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পরের দুটি উপন্যাসে ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ অনুসরণ সত্ত্বেও কল্পনার উল্লেখযোগ্য স্থান আছে।
বঙ্গবিজেতা টোডরমল্লের তৃতীয়বার বঙ্গবিজয়ের পটভূমিতে রচিত-ঘটনাকাল স্পষ্ট করেই চিহ্নিত করা আছে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। সে-সময়ে বাংলার হিন্দু জমিদারের উত্থান-পতনের কাহিনি এতে যুক্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাপের পতন ও পুণ্যের জয় দেখানো হয়েছে। রমেশচন্দ্র বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন যুদ্ধবর্ণনায় এবং প্রকৃতিবর্ণনায়। চারিত্রচিত্রণ অনেকখানি গতানুগতিক। তবে মহাশ্বেতার জিঘাংসা তাকে অন্যান্য চরিত্র থেকে পৃথক করেছে। সরলা ও বিমলার সরল নির্মল সখ্যও পাঠককে আকৃষ্ট করে। তবে ইন্দ্রনাথ ও সরলার প্রেম যে সেযুগের বাস্তবতা রক্ষা করে কল্পিত হয়েছে, তা বোধহয় বলা যায় না। শকুনি একেবারেই বিশ্বাসঘাতক ও অনুতাপহীন পাষ-Ñশেক্পিয়রের ভাষায় যাকে বলা যায় treacherous, remorseless villain- টোডরমল্লের বিচার এড়াবার জন্যে সে নানারকম চেষ্টা করেছে, তারপর সেই বিচারস্থানেই রাজার উপস্থিতিতে তার আত্মহত্যা তেমন প্রতীতি জন্মায় না।
দুর্গেশনন্দিনী ও বঙ্গবিজেতা পটভূমির সাদৃশ্য পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। বাঙ্গবিজেতা রচিত হতে হতে বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক রোমানসের কয়েকটির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হয়ে গেছে। চন্দ্রশেখর ও বঙ্গবিজেতা প্রায় সমসাময়িক মানবচরিত্রাঙ্কণে বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষতা রমেশচন্দ্র অর্জন করেননি। সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনায় রমেশচন্দ্রে প্রথম থেকেই খানিকটা পিছিয়ে ছিলেন। সুকুমার সেন বঙ্গবিজেতায় বিদেশি প্রভাব লক্ষ করেছেন। তা খানিকটা চরিত্রচিত্রণে, খানিকটা বাঙালি ‘গৃহে গৃহে শীতনিবারণার্থ অগ্নি’ জ্বালানোর বর্ণনায়। তবে রমেশচন্দ্রের ভাষায় সারল্য ও গতি আছে, এ-কথা স্বীকার করতে হয়। তাঁর পাত্রপাত্রীর সংলাপের ভাষা সাধুরীতির, কিন্তু তা সরল বলেই কথ্যভাষার কাছাকাছি বলে মনে হয়। পরে উপন্যাসরচনায়Ñবিশেষ করে, শেষ- দু’টিতেÑরমেশচন্দ্র অনেকখানি সিদ্ধিলাভ করতে পারি। বঙ্গবিজেতায় রমেশচন্দ্রের উপন্যাসরচনার সূচনা, বঙ্গদেশের হারানো একটি যুগের চিত্র পুনর্গঠনের প্রায়াস এতে আছে। তাই আমরা একে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি বিবেচনা করি। -আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়