
শ্রীকান্ত
পুরুষের প্রতি নারীর প্রেম দাম্পত্য-সম্পর্কের মধ্যে যেমন তার বাইরেও তেমনি প্রবলভাবে প্রবাহিত হতে পারে। অন্নদাদিদি ও অভয়া তারই উদাহরণ। তাদের জীবনাচরণে বড়োরকম পার্থক্য সত্ত্বেও অভয়াকে দেখে শ্রীকান্তের অন্নদাদিদিকে মনে পড়ার মধ্যে এই বার্তাই নিহিত। কিন্তু শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর প্রেম অনুরূপ ভিত্তিভূমি লাভ করতে সমর্থ হয়নি। কখনো রাজলক্ষ্মীর সপত্নীপুত্র বঙ্কুর প্রতি মাতৃস্নেহে কখনো বা তার প্রবুদ্ধ ধর্মবুদ্ধি তার পক্ষে একধরনের বাধার সৃষ্টি করেছে। সে-বাধা শ্রীকান্তের দিক দিয়ে প্রবলতর মনে হয়। অবস্থাগতিকে রাজলক্ষ্মীকে সে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়েছে, তার বাঈজী-জীবনের পুনরাবির্ভাবে তাকে তীব্র বিদ্রূপ বিদ্ধ করেছে, কিন্তু রাজলক্ষ্মীকে সে সত্যিই বলেছে যে, তার জন্যে সে সবকিছু ত্যাগ করতে পারে-তবে সম্ভ্রম নয়। পাঠকের মনে সংগতভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, সম্ভ্রম ছাড়া ত্যাগ করার মতো আর কী বা আছে শ্রীকান্তে-তাই যদি ত্যাগ না করতে পারলো, তবে ত্যাগ করার বড়াই করা নিরর্থক। শেষ পর্যন্ত যে রাজলক্ষ্মীকে কমললতার সঙ্গে সংগীত-প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে-বস্তুত তা কমললতার কাছে শ্রীকান্তকে হারাবার ভয়ে রাজলক্ষ্মীর দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হওয়ার অশোভন প্রয়াসÑতা তার আবাল্যসঞ্চিত প্রেমের প্রবল অবমাননাস্বরূপ।
শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর প্রেম এই চারপর্ব উপন্যাসের কেন্দ্রীয় কাহিনি। কিন্তু বহু ঘটনা ও চরিত্র এই মূল ধারায় এসে মিলেছে। ইন্দ্রনাথের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রবল সাহস, নতুন-দার কমিক রিলিফ, অন্নদাদিদির প্রেম, টগর বোষ্টমীর উপাখ্যান, প্রবাসী বঙ্গসন্তানদের বর্মী স্ত্রীকে প্রতারণা, স্বামীর আশ্রয়লাভে ব্যর্থ অভয়ার রোহিনীকে অবলম্বন করে নতুন জীবনযাপনে প্রবৃত্তি, সুনন্দার তেজোদীপ্ত জীবন, জীবনের প্রতিটি স্তরে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গহরের ব্যর্থতা, আশ্রমবাসিনী কমললতার জীবনে শ্রীকান্তের আবির্ভাবে চাঞ্চল্য-এরকম অনেক কিছু তার উদাহরণ। বাঙালির প্রাত্যাহিক জীবনের অকিঞ্চিৎকরতা ও জীবনচক্রের পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি শ্রীকান্তের অভিজ্ঞতার এই বিস্তৃতি-তার দুর্লভ মাধুর্য এবং সুরের উচ্চাবচতা-জীবনকে গভীরভাবে অনুভব করতে আমাদের সাহায্য করে।
এই উপন্যাসের শরৎচন্দ্রের ভাষা ও ভঙ্গির সারল্য, অন্তরঙ্গতা এবং কখনো কখনো গভীর কবিত্বপূর্ণ প্রকাশ আমাদের মুগ্ধ করে। গল্পকথনের কী অসাধারণ ক্ষমতার তিনি অধিকারী, তা আমরা বুঝতে পারি। কথনের এই কুশলতাই তাঁকে বাঙালি পাঠকের কাছে আদরণীয় করে তুলেছে-তাঁর যুগে এবং যুগান্তরেও।
বর্তমান গ্রন্থমালায় সুকুমার সেন-সম্পাদিত ও আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড প্রকাশিত সুলভ শরৎসমগ্রের (১৯৮৯) পাঠ অনুসৃত হয়েছে।
-আনিসুজ্জামান
জানুয়ারি ২০০৯
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।