বিষাদ-সিন্ধু
ভূমিকাঃ
বিষাদ-সিন্ধু সন্দেহাতীতরূপে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। কারবালার বিষাদান্ত ঘটনা এই গ্রন্থের বর্ণিত বিষয়। বইটির তিন পর্ব-মহররম পর্ব, উদ্ধার পর্ব ও এজিদবধ পর্ব- প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৫৫, ১৭৮৭, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে। গ্রন্থকার বলেছেন, ‘পারস্য ও আরব্য গ্রন্থ হইতে মূল ঘটনার সারাংশ লইয়া বিষাদ-সিন্ধু বিরচিত হইল।’
মশাররফ হোসেন আরবি-ফারসি জানতে কিনা এবং জানলে কেমন জানতেন, তার স্পষ্ট বিবরণ কোথাও পাওয়া যায় না। মনে হয়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রকাশিত মকতুল হোসেন, জঙ্গনামা ও শহীদে কারবালার মতো মিশ্রভাষারীতির কাব্য বা দোভাষী পুথির কাঝেই কাহিনিভাগের জন্যে তিনি ঋণী। তবে মশাররফ হোসেন শুধু কাহিনির সূত্রই সেখান থেকে নিয়েছিলেন, নিজের থেকে যোগ করেছিলেন অনেক কিছু। শিয়া-মতাবলম্বী ফারসি কাব্য-রচয়িতাদের কাছে যেমন, তেমনি দোভাষী কবিদের কাছেও এই কাহিনিকথনের অন্তরালবর্তী আবেগ তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গস্বরূপ ছিল। এজিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং হাসান-হোসেনের প্রতি প্রবল ভক্তি তাঁদের হৃদয় থেকে স্বতোৎসারিত হয়েছে। মশাররফ হোসেন ধর্মবুদ্ধির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে উপাখ্যান রচনা করতে বসেননি- ঐতিহাসিক চেতনার দ্বারা প্রণোদিত হয়ে তো নয়ই (মশাররফ হোসেন ইতিহাস-ব্যাখ্যার অনেক ভ্রান্তি নির্দেশ করেছিলেন কায়কোবাদ)। কারবালা-কাহিনির মধ্যে নিয়মিত-নিপীড়িত মানবভাগ্যের যে-করুণ লীলাখেলা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেখানে তিনি প্রেরণালাভ করেছিলেন মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে।
হাসান-হোসেনের সঙ্গে এজিদের বিরোধ রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বপ্রসূত, এ-কথা ঐতিহাসিক সত্য। মশাররফ হোসেনের রচনায় এই সংঘাতের মূল কারণ এজিদের অনিবার্য রূপতৃষ্ণা। সেই রূপতৃষ্ণার উদ্ভ্রান্তকারী শক্তিকে গ্রন্থকার সামাজিক মনের দ্বারা চালিত হয়ে নিন্দা করেননি, শিল্পীমন দিয়ে সবিস্ময়ে অবলোকন করেছেন। এই প্রেমের মধ্যে তিনি দেখেছেন নিয়মিত অদৃশ্য হস্তের খেলা। তাই রূপতৃষ্ণার কাতর এজিদ যে-রোষবহ্নির সূত্রপাত ঘটিয়েছে, তাতে একে একে প্রেরিত পুরুষের প্রায় সকল বংশধর সানুচর আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই সর্বনাশা পরিণাম সম্পর্কে একটি পূর্বধারণা দেওয়া হয় প্রধান শিষ্যম-লীর মধ্যে আসীন প্রভু মোহাম্মদকে জেব্রাইল কর্তৃক পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আদেশবাক্য-জ্ঞাপনে। তারপর থেকে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু অদৃষ্টের নাগপাশ থেকে হাসান-হোসেনের মুক্তি ঘটেনি। আবার যে-মুহূর্তে শত্রুজিৎ এজিদ সাফল্যের বরমাল্য লাভ করেছে, সেই মুহূর্ত থেকে সর্বনাশা নিয়মিত তাকে গ্রাস করার জন্যে ছুটে চলেছে। এজিদের পতনে বাহ্যত প্রধান ভূমিকা মোহাম্মদ হানিফার। সেই হানিফাও কিন্তু নিয়তি নির্ধারিত দণ্ড থেকে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়নি। বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মানবজবনের এই অদৃষ্টলাঞ্ছিত রূপের আলেখ্য, পুরুষকারের এই শোচনীয় পরিণামের কাহিনী ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হয়েছে।
মানবভাগ্যের এই আবেগময় রূপায়ণের জন্যেই বিষাদ-সিন্ধু মূল্যবান। রচনারীতির পরিপাট্য, কাহিনির নাটকীয়তা, ঘটনার চমৎকারিত্ব ও চরিত্রবিত্রণের দক্ষতা প্রথম পর্বে যেমন দেদীপ্যমান, পরবর্তী দু-খণ্ডে তেমন নয়। তবে এর ভাষা আগাগোড়াই পুষ্পিত, গতিময়, ধ্বনিতরঙ্গবিশিষ্ট। ভাষা এই রচনার বিশিষ্ট সম্পদ।
বর্তমান মুদ্রণে কাজী আবদুল মান্নান সম্পাদিত ও বাংলা একাডেমী প্রকাশিত মশাররফ রচনা-সম্ভার (১৯৮০) দ্বিতীয় খণ্ডের পাঠ অনুসৃত হয়েছে।
-আনিসুজ্জামান
জানুয়ারি ২০০৯
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।