পথের পাঁচালী
তাঁকে জিজ্ঞাসা না করেই এক বালক তাঁর উপন্যাসের বিজ্ঞাপন বিলি করে বসেছিল- যদিও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) তখনো সাহিত্যচর্চার কথা ভাবেননি। নিজের মান বাঁচাতেই তাঁকে লিখতে হলো জীবনের প্রথম গল্প আর সেটি প্রকাশিতও হলো প্রবাসী পত্রিকায়। এমনি করে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব-কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। প্রথম গল্পপ্রকাশের চার বৎসর পরে বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন উপন্যাস। এটিই পথের পাঁচালী (১৯২৯)-প্রকাশমাত্রই তা এনে দেয় বাংলাসাহিত্যে তাঁর অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা। এ উপন্যাসটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘এর থেকে শিক্ষা কিছুই হয়নি, দেখা হয়েছে অনেক যা পূর্বে এমন করে দেখিনি।’ পরিচিত পরিবেশকে নতুন করে দেখা ও দেখানোর আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
পথের পাঁচালী মুখ্যত শিশু অপুর বড়ো হয়ে ওঠার কাহিনি। যে-পথ দিয়ে জীবনে সে অগ্রসর হয়েছে, যেসব মানুষের সংস্পর্শে সে এসেছে, তা সেই কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর পটভূমিটি সুবিস্তৃত। পূর্বপুরুষ ঠ্যাঙাড়ে বীরু রায়ের উপাখ্যান যদিও দূর ইতিহাসের অঙ্গীভূত, কৌলীন্যপ্রথার অমানবিক যন্ত্রে পিষ্ট ইন্দির ঠাকরুণের জীবনের ইতিহাস অত সুদূরের নয়। ইন্দির ঠাকরুণের প্রতি সর্বজয়ার আচরণ সবসময়ে মানবিক নয়। যে-মা দুর্গা ও অপুর জীবনে উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত, পিসির প্রতি তার রূঢ় ব্যবহার তাদের জীবনের প্রাথমিক অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। উপন্যাসের পরবর্তী অংশ অপু-দুর্গার শৈশবকাহিনি-সে-কাহিনি অভিনবত্বে অসাধারণ নয়, কিন্তু মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তারা দুজনেই গ্রাম্য প্রকৃতিকে ভালোবাসে, রেলপথ তাদের কাছে এক রহস্যজগতের বার্তা পৌছে দেয়। নতুন নতুন অভিযানে দুর্গা অপুর পথপ্রদর্শক, তবে অপুর মধ্যে অনুভূতির যে-প্রখরতা এবং ভাবুকতার যে-দোলা লক্ষ করা যায়, দুর্গার মধ্যে আমরা তা দেখি না। তবু চরিত্র হিসেবে এরা কেউই আদর্শায়িত নয়, প্রলুব্দ দুর্গা চুরি করতেও কুণ্ঠিত হয় না-সে-চুরির চিহ্ন মুখে দিতে অপু পরে তৎপর হয়, ততদিনে অবশ্য দুর্গা আর নেই। দুর্গার মৃত্যু অপুর জীবনে বড়োরকম আঘাত হানে, তার অভ্যস্ততায় ছেদ টানে, কিন্তু তা অপুর স্বাধীন বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার পথও উন্মুক্ত দেয়। এরপর কাহিনি একান্তই অপুর।
জীবন ও প্রকৃতিকে অপু অবলোকন করেছেন অপরিসীম বিস্ময় ও গভীর মুগ্ধতার সঙ্গে। অপুর দুই পা বাস্তব পৃথিবীতে প্রোথিত, কিন্তু তার দু-চোখে রোমান্সের অঞ্জন। স্বভাবসিদ্ধ কল্পনাপ্রবণতা ও তীক্ষè সৌন্দর্যানুভূতির গুণে সে মানুষের মধ্যে যে-বিজন মহত্ত্ব অনুভব করে এবং প্রকৃতির মধ্যে যে-ঐন্দ্রজালিক মোহনীয়তার সন্ধান পায়, অন্যের কাছে তা সহজে ধরা দেয় না। আমরা যে শ্রীহীন গ্রামকে জানি, যে-দারিদ্রপীড়িত মানুষকে চিনি, যে-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, এখানে তার সবই অন্যরকম শ্রী, অন্যরকম শক্তি, অন্যরকম অবয়ব নিয়ে ধরা পড়ে। বস্তুর রূপকে ভেদ করে স্বরূপের উপলব্ধি অপুর দৃষ্টিভঙ্গির বড়োকথা। এই দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত বলে ঔপন্যাসিকের আত্মস্মৃতিমূলক এই উপন্যাস এমন মোহনীয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমান মুদ্রণে মিত্র ও ঘোষ-প্রকাশিত পথের পাঁচালীর (১৩৬৬) পাঠ অনুসৃত হয়েছে।
-আনিসুজ্জামান
জানুয়ারি ২০০৯
সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।
সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।