Image Description

আলালের ঘরের দুলাল

৳230
Format Hardcover
Year 2009
Language Bangla
ISBN 978 984 20 0135-2
Edition 1st
Pages 152

ভূমিকাঃ
মাসিক পত্রিকায় ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৫৭ সালের জুন পর্যন্ত ‘আলালের ঘরের দুলালে’র ২০টি অধ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সম্পূূর্ণীকৃত রচনাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে।

১৮২১ সাল থেকে বাংলায় আখ্যান ও নকশা প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হানা কাথেরীন ম্যলেন্সের ফুলমণি ও করুণার বিবরণে উপন্যাস রচনার প্রয়াস আছে। কিন্তু আলালের ঘরের দুলালই প্রথম উপন্যাসপদবাচ্য। তবে অনেকেই একে উপন্যাস বলতে কুণ্ঠিত হন। কাহিনির ধারাবাহিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বাস্তব চিত্রাঙ্কণ এবং চরিত্রচিত্রণের দক্ষতা বিবেচনা করে একে উপন্যাসই বলতে হয়। নকশার রীতি এর ওপর প্রভাববিস্তার করেছে। তাই এর চরিত্রগুলি সাদা অথবা কালো রঙ্গে চিত্রিত-সেখানে ধূসরের কোনো স্থান নেই।

আলালের ঘরের দুলালের প্রশংসা যাঁরা করেছেন, তাঁরা সকলেই এর দুটি গুণের কথা বলেছেন-এর ভাষা ও বিষয়বস্তুর দুইই ঘরের থেকে নেওয়া। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায়, যে ভাষা সকল বাঙ্গালির বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালি কর্ত্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থপ্রণয়নে ব্যবহার করিলেন।... আর তাঁহার দ্বিতীয় অক্ষয় কীর্ত্তি এই যে, তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে,Ñতাহার জন্য ইংরাজি বা সাংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। ... প্রকৃত পক্ষে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের আদি “আলালের ঘরের দুলাল”।

আলালের ঘরের দুলালের ভাষা বস্তুতপক্ষে কলকাতার কথ্যভাষা কলকাতার সন্নিহিত বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা এবং সাহিত্যে ব্যবহৃত সাধুভাষার মিশ্ররূপ। মনে রাখতে হবে, সেযুগে নানারীতির ভাষার মিশ্রণ দুষণীয় বিবেচিত হতো না। প্যারীচাঁদ তাঁর প্রথম দুটি বইতে মৌখিক ভাষার কাছাকাছি এই মিশ্রিত ভাষারীতিই মূলত প্রয়োগ করেছিলেন এবং তাতেই ভাষাব্যবহারের ক্ষেত্রে বড়োরকম পরিবর্তন ঘটে গিয়েছি। তবে, বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলেছিলেন যে, এ-ভাষাকে আদর্শ বিবেচনা করা যায় না, কিন্তু ভাষা কেমন হওয়া উচিত, তা উপলব্ধি করতে এ-ভাষা সহায়ক হয়েছিল। পরবর্তীকালে ভাষার এ-আদর্শ থেকে সরে এসে প্যারীচাঁদ সাধুভাষাই অবলম্বন করেছিলেন, তবে আলালের ঘরের দুলালে যার সূচনা হয়েছিল, সে-ভাষার ঐতিহাসিক মূল্য চিরকালীন।

এই উপন্যাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কলকাতা এবং তার আশেপাশের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের বিশ্বস্ত চিত্র ধরা পড়েছে। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় কেমন ক্ষয় ধরেছিল, তার কিছু পরিচয় এতে পাই। গ্রন্থকার যে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির পক্ষপাতী, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। নগর ও গ্রাম উভয়েরই চিত্র এতে উপস্থিত। ইংরেজের নব্যসৃষ্ট আদালত কিভাবে কাজ করছে, তাও এতে দেখা যায়। নীতিউপদেশদানের যে- প্রবণতা প্যারীচাঁদের লিছ, তা এতে ফুটে উঠেছে, যদিও তাঁর অনেক রচনায় নৈতিক ভাবের যে-প্রাবল্য, তা এতে নেই। চরিত্রচিত্রণে প্যারীচাঁদ যে একদেশদর্শী ছিলেন, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মতিলাল সৎশিক্ষা ও যথাযথ পরিচালনার অভাবে ধনীর আদরের সন্তানের নষ্ট হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত মতিলালের সঙ্গীরাও-হলধর, গধাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ. মানবগোবিন্দ্র-এবং থার প্রশ্রয়দাতার-বাঞ্জারাম, বক্রেরশ্বর, বটলর-সকলেই দুর্বৃত্তস্বভাবের কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ। এদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র মোকাজান মিয়া ওরফে ঠকচাচার।

নিজের কৃতকর্মের অসততা সম্পর্কে ঠকচাচা সচেতন, কিন্তু নিজের কাছে এবং অন্যের কাছেও তার সপক্ষে তুলে ধরার মতো যুক্তি তার আছে: ‘দুনিয়াদারি করতে গেলে ভালা বুরা দুই চাই-দুনিয়া সাচ্চা নয়-মুই একা সাচ্চা হয়ে কিরবো? ক্ষণিকের জন্যে দেখা দিলেও ঠকচাচীও আমাদের মনে দাগ কেটে যায়। অন্যপক্ষে রামলাল ও বরদাদবাবুর সুশিক্ষা ও সকৃতি সত্তে¡ও তাঁরা যতটা আদর্শের প্রতীক অতটা জীবন্ত মানুষ নন। তবে প্যারীচাঁদের বর্ণনার স্বাভাবিক সরসতা সমগ্র রচনাটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে। এতকালের ব্যবধানেও তাই বইটির আবেদন নিঃশেষিত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র যে-ভবিষণ্যদ্বাণী করেছিলেন-“আলালের ঘরের দুলাল” বাঙ্গালা ভাষায় চিরস্থায়ী ও চিরস্মরণীয় হইবে’- তা সত্য হয়েছে।

প্যারীচাঁদ মিত্র প্রায় সারাজীবনই ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির বৈতনিক ও অবৈতনিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হয়। তখন থেকে তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন, প্রেতচর্চায় মনোযোগী হন এবং কর্নেল ওলকট ও মাদাম ব্লাভাটস্কির থিওসফিকাল সোসাইটির বঙ্গীয় শাখা গঠন করেন। তাঁর শেষদিকের রচনায় এই মানসিকতার সুস্পষ্ট ছায়াপাত হয়েছে।

বর্তমান মুদ্রণের ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস-সম্পাদিত বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ সংস্করণের (১৩৪৭) পাঠ অনুসৃত হয়েছে।
-আনিসুজ্জামান
জানুয়ারি ২০০৯

সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালা আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের একটি সিরিজ প্রকাশনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আখ্যায়িকার শুরু, এ-কথা বলা যায়। ১৮৫৪ সালে তিনি কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের উপাখ্যানভাগ বাংলায় পরিবেশন করেন। এরপর প্রায় শতবর্ষ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের যে-বিকাশ তার শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থগুলেকে পাঠকের কাছে একত্রে তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সিরিজটি পরিকল্পিত হয়েছে।

সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের কাছে সাহিত্যকীর্তি গ্রন্থমালার ২৪টি বই একসঙ্গে পাওয়া অত্যন্ত খুশির বিষয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামীতেও এরকম কিছু গ্রন্থ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো বলে আমরা আশা রাখি।

Tek Chand Thackoor / টেকচাঁদ ঠাকুর

আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে পরিগণিত। টেকচাঁদ ঠাকুর নামের অন্তরালে আত্মগোপণকারী এর রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩) ছিলেন হিন্দু কলেজে কৃতবিদ্য ছাত্র, ডিরোজিওর অগ্রগণ্য শিষ্য। ইয়ং বেঙ্গলের আরেকজন সদস্য রাধানাথ সিকদার-সহযোগে ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি মাসিক পত্রিকা নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন।

পত্রিকায় এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়: এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষত স্ত্রীলোকের জন্য ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে পত্রিকা লিখিত হয় নাই।